বিকেলে অফিস থেকে বের হয়ে দোতলায় করিডোর ধরে হাঁটছে মাসুদ। এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই জিজ্ঞেস করলো, মাসুদ ভাই বলছেন?
কাংখিত মোবাইল বন্ধ থাকলে বা কানেকশন না পাওয়া গেলে যে শ্রুতিমধুর নারী কন্ঠ শোনা যায় এ কন্ঠটি ঠিক সে রকম।
আবার জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি মাসুদ ভাই?
মাসুদ বললো, হ্যাঁ, বলছি। আপনি কে বলছেন?
মেয়েটি বললো, আমি ফারজানা। আপনি কি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়েন?
মাসুদ বললো, এক সময় পড়তাম।
মেয়েটি জানতে চাইলো, এটা কোথায় একটু বলবেন প্লিজ?
মাসুদ বললো, খুলনা।
অপরাধী কন্ঠে মেয়েটি বললো, স্যরি।
পরদিন সকালে এসএমএস এলোঃ
মাসুদ ভাই, আপনি কোথায়? আপনার অবস্থান কিছুতেই ট্রেস করতে পারছি না। কিছুক্ষণ পরেই পরীক্ষা শুরু হবে। প্লিজ, তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করুন।
বিকেলে আবার এসএমএস এলোঃ
আপনি মাসুদ ভাই? ফাজিল কোথাকার। মিথ্যা কথা বলে খুব শান্তি পান বুঝি?
এরপর আর যোগাযোগ হলো না।
কিন্তু এপ্রিলের ৩০ তারিখ থেকে ডিসেম্বরের শেষ ভাগ পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় আট মাস মাসুদ ঐ এসএমএস দুটো সংরক্ষণ করে রাখলো।
অবিবাহিত জীবনের একাকীত্বের কারণে মাসুদ ভাবলো, ফারজানার সাথে পরিচিত হওয়া যায় না?
দুরু দুরু বুকে ফোন করলো।
রিসিভ করেই ফারজানা জানতে চাইলো, হ্যালো, কে বলছেন?
মাসুদ বিনয়ের সাথে বললো, আমাকে আপনি চিনবেন না। আট মাস আগে আপনার মোবাইল থেকে আমার মোবাইলে কল এবং দুইটা এসএমএস এসেছিলো। আপনার সম্পর্কে জানার কৌতুহল হওয়ায় অপরাধ হবে জেনেও ফোন করেছি।
ফারজানা জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি করেন?
মাসুদ বললো, কুয়েটে চাকরি করি। আপনি কোথায় থাকেন তা কি জানানো যাবে?
ফারজানা বললো, আমি ঢাকার গুলশানে থাকি।
অল্প বয়স্ক মনে হওয়ায় মাসুদ জিজ্ঞেস করলো, আপনি কোথায় পড়াশোনা করেন?
ফারজানা বললো, একটা বেসরকারি ভার্সিটিতে বিবিএ ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।
মাসুদ বললো, একজন অপরিচিতের সাথে বিরক্ত না হয়ে এতটা সময় ভালোভাবে কথা বলার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ফারজানা বললো, বিরক্ত হওয়ার মত কিছু না বললে বিরক্ত তো না হওয়াই উচিৎ।
মাসুদ খুশী হয়ে বললো, হ্যাঁ, তা তো ঠিকই। আচ্ছা রাখছি, ভালো থাকবেন।
পরদিন ফারজানা এসএমএস দুটো তার মোবাইলে ফরোয়ার্ড করতে বললো।
ওগুলো মুছে দেয়নি বলে নিজের উপর খুব সন্তুষ্ট হলো মাসুদ। এসএমএস দুটো ফরোয়ার্ড করলো।
পরদিন ফারজানা নরম স্বরে বললো, হ্যাঁ, এসএমএস দুটো আমিই পাঠিয়েছিলাম। মাসুদ নামের একজনের কাছে আমি প্রাইভেট পড়তাম। সেদিন আমার পরীক্ষা ছিল। তার সঙ্গে যোগাযোগ হলে পরীক্ষা কিছুটা হলেও ভালো হতো। একটা ডিজিট ভুল হওয়ায় আপনার মোবাইলে কল চলে গিয়েছিল।
একটু কঠোর গলায় আবার বললো, যেদিন ফোন করেছিলাম সেদিন আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি মাসুদ কিনা। আপনি হ্যাঁ বলেছিলেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি যে আপনি মাসুদ না।
মাসুদ বললো, আমার পুরো নাম মোঃ আব্দুল্লাহ আল মাসুদ। সে হিসাবে আমাকে সবাই মাসুদ নামে ডাকে। আপনার বিশ্বাস না হলে প্রমাণ করে দেখতে পারেন।
ফারজানা বললো, আমি তা করতে যাবো কেন?
মন থেকে কিছুতেই বিষয়টা ঝেড়ে ফেলতে পারলো না মাসুদ।
তাই ফোন করে ফারজানাকে বললো, আপনাকে একটা কথা বলার জন্য ফোন করেছি, কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আপনার ধারণা যে আমি মাসুদ না হয়েও আপনাকে বলেছি যে আমি মাসুদ। এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। কারণ আমার নাম সত্যিই মাসুদ।
ফারজানা আবেগ ভরা কন্ঠে বললো, ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, জানেন! ফোন করলাম একজনের কাছে, ভুলক্রমে আপনার কাছে চলে গেল। তার নাম আর আপনার নাম একই। এটা কিভাবে সম্ভব হলো? এ যে অলৌকিক ঘটনার মত।
এরপর ওদের মধ্যে কথা চলতে থাকলো।
এক রাতে ফারজানা ফোন করে জিজ্ঞেস করলো, আপনি দেখতে কেমন?
মাসুদ কি উত্তর দেবে তা চিন্তা করতে লাগলো। ফারজানা আবার জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি ফর্শা?
এবার মাসুদ বললো, হ্যাঁ।
ফারজানা জিজ্ঞেস করলো, আপনার উচ্চতা কত?
মাসুদ বললো, পাঁচ ফিট সাড়ে চার ইঞ্চি। আপনার?
ফারজানা বললো, পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চি।
মাসুদ জিজ্ঞেস করলো, আপনার চুল কি লম্বা না খাটো?
ফারজানা জানালো, অনেক লম্বা।
মাসুদ উৎফুল্ল হয়ে বললো, ওহ তাই? লম্বা চুল আমার খুব পছন্দ। চুল লম্বা হলে বড় খোঁপা হয়।
ফারজানা বললো, কিন্তু আমার চুল খুব কম। তাই খারাপ দেখাবে বলে বড় করে রাখতে হয়।
মাসুদ বললো, তা হোক, কিন্তু চুল তো বড়।
ফারজানা বললো, আমি তো দুধে-আলতা ফর্শা।
মাসুদ জানতে চাইলো, আপনারা কয় ভাই-বোন?
ফারজানা বললো, আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।
একসময় ফারজানা বললো, আমাদের এই আলাপচারিতা, এই যে সম্পর্ক এটাকে কি বলে আখ্যায়িত করা যায়?
মাসুদ একটু ভেবে বললো, আমরা একে অপরের বন্ধু।
ফারজানা উৎফুল্ল কন্ঠে বললো, হ্যাঁ, আমরা বন্ধু। আর আমি আপনার অনেক ছোট হলেও এখন থেকে কিন্তু তুমি করে বলবো।
মাসুদ শিহরিত হয়ে বললো, ঠিক আছে। অবশ্য আমার কয়েকদিন সময় লাগবে। এখনই বলতে লজ্জা লাগছে।
ফারজানা জিজ্ঞেস করলো, তোমার বাড়ি কি খুলনাতে?
ফারজানা এখনই তুমি বলা শুরু করেছে শুনে মাসুদের অন্যরকম অনুভুতি হলো। তারপর বললো, না। আমার বাড়ি পাবনা।
একদিন ফারজানা জানালো যে তার বাবা যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তারাও সেখানে চলে যাবে শুনে আতঙ্কগ্রস্থের মত মাসুদ বললো, তোমরা চলে যাবে মানে?
ফারজানা বললো, মাস তিনেক পর আবার চলে আসবো।
মাসুদ স্বস্তি পেল। কিন্তু সে ফারজানাকে প্রথমবার তুমি করে বলায় ফারজানা হাসছে। তা শুনে মাসুদ জিজ্ঞেস করলো, হাসছো কেন?
ফারজানা বললো, এমনিই।
একদিন মাসুদ বললো, আমার বাবা তিনটা প্রবন্ধ টাইপের বই লিখেছেন। বইগুলোর কম্পিউটার কম্পোজ আমি নিজে করেছি। তোমার কাছে সেগুলো পাঠাতে চাই। তোমার ঠিকানাটা দাও।
ফারজানা বললো, ঠিক আছে, দিচ্ছি।
দুইদিন পর ফারজানা ফোন করে উত্তেজিত স্বরে বললো, তোমার বাবার বইগুলো তো মানুষের পড়া দরকার। আমার কাছে থাকলে তো সেলফ-এর ভিতরে থাকবে। তাই ওগুলো কোন লাইব্রেরীতে দিতে চাই।
মাসুদ বললো, দাও। তোমাকে আমি আরো পাঠাবো।
একটা বইয়ের এক জায়গায় আছে যে সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে সে ব্যাপারে স্ত্রীর নির্ধারকের কোন ভুমিকা নেই। নির্ধারকের ভুমিকা স্বামীর। তাই মেয়ে হলে যে সব স্বামীরা স্ত্রীদের উপর অত্যাচার করে সেটা ভুল ও অপরাধ। মাসুদ ভাবলো, হয়তো এটাও ফারজানার মন্তব্যের একটা কারণ।
এক সময় ফারজানার মোবাইল বন্ধ পেল মাসুদ।
তিন মাস পর হঠাৎ একদিন কল ঢুকলো। মাসুদ জানতে চাইলো, তোমার মোবাইল এতদিন বন্ধ ছিল কেন?
ফারজানা বললো, আমার খুব সমস্যা হচ্ছিলো, তাই বন্ধ রেখেছিলাম।
মাসুদ জানতে চাইলো, কি সমস্যা?
ফারজানা বললো, তোমার প্রতি আমার দুর্বলতা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিলো। কিন্তু আমাকে যদি এদেশ ছেড়ে শেষ পর্যন্ত চলে যেতে হয় তবে শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে লাভ কি?
মাসুদ আকাশ থেকে পড়লো। বললো, প্লিজ, মোবাইল চালু রেখো।
ফারজানা হেসে বললো, আচ্ছা।
মাসুদ জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কবে যাবে?
ফারজানা বললো, মম তো চলে গেছেন। কিন্তু আমার জন্ডিস ধরা পড়ায় আমি যেতে পারিনি। আমি বর্তমানে ক্লিনিকে আছি।
কিছুদিন পর হঠাৎ এক রাতে ফারজানা বললো, আগামীকাল রাতে আমার ফ্লাইট। তুমি আজ রাতে অবশ্যই ঢাকা রওনা হও।
মাসুদ বললো, চেষ্টা করবো।
মাসুদ না যাওয়ায় পরদিন ফারজানা ফোন করে ভারাক্রান্ত গলায় বললো, খুব আশা করেছিলাম তুমি আসবে, আমি তোমাকে ভায়োলিন শোনাতে চেয়েছিলাম।
মাসুদ বললো, প্লিজ, কিছু মনে কোরো না। তুমি তো আবার ফিরে আসছোই। তখন দেখা করবো।
ফারজানা আবেগভরা গলায় বললো, জানো, আমার আসলে যেতে ইচ্ছা করছে না। আমার এই অনীহায় মম বলেছেন যে আমি বোধহয় এ দেশে কারো সাক্ষাৎ পেয়েছি।
ফারজানা আবার বললো, তোমার মেইলিং ঠিকানাটা এবং ই-মেইল ঠিকানাটা দাও। প্রত্যেকদিন আমাকে ই-মেইল পাঠাবে কিন্তু।
ফারজানা বিকালে মাসুদকে ই-মেইল পাঠিয়ে ফোন করে তা জানালো। মাসুদ দেখলো যে ফারজানা লিখেছেঃ
তোমার একটা নতুন নাম দিলাম সুহৃদ।
আমার ভাব, ভাষা, ভাবনা এক সুতার আলিঙ্গনে মালা হয়ে উঠতে পারে না। কি লিখবো জানি না। কিছু লিখতে বসলে কবিতা আর গানের কলি মনে আসে। হঠাৎ পেলাম তোমার দেখা, যেদিন থেকে আমার পৃথিবী আমার মত একা।
আল্লাহ্ আমাদের সকলের মঙ্গল করুন। আমার জন্য দোয়া কোরো।
মাসুদ উত্তর দিলঃ
ফারজানা,
শুভেচ্ছা।
আমার নতুন নাম দেওয়ার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
তোমার ই-মেইল পেয়ে সত্যিই আমি আনন্দিত। এমন ই-মেইল সারাজীবন যেন পাই। তোমার সুখী ভবিষ্যৎ জীবন কামনায়।
মাসুদ
ফারজানা লিখলোঃ
কেউ যদি আমাদের শত্রু হয় তবে আমরা তাকে ধন্যবাদ বলি না
কেউ যদি আমাদের শুভাকাংখি হয় তবে আমরা তাকে ধন্যবাদ বলি না
কেউ যদি আমাদের আত্মীয় হয় তবে আমরা তাকে ধন্যবাদ বলি না
কেউ যদি আমাদের বন্ধু হয় তবে আমরা তাকে ধন্যবাদ বলি না
কেউ যদি আমাদের অপরিচিত হয় কেবলমাত্র তখনই আমরা তাকে ধন্যবাদ বলি।
আমি নিরাপদে পৌঁছেছি।
মাসুদ লিখলোঃ
ফারজানা,
তুমি নিরাপদে পৌঁছেছো জেনে দুশ্চিন্তামুক্ত হলাম।
তোমার সাথে মাঝে মাঝে কথা বলতাম, কিন্তু এখন পারছি না। ফারজানা, আমি তোমাকে প্রতিটা মুহূর্ত মিস করি। তোমার মঙ্গল কামনায়।
মাসুদ
দুইদিন পর কোন ই-মেইল না পেয়ে মাসুদ আবার লিখলোঃ
ফারজানা,
আজ আশা করেছিলাম তোমার মেইল পাবো, কিন্তু পেলাম না। বাবা-মাকে কাছে পেয়ে আমার কথা ভুলে গেছো। ঠিক আছে।
মাসুদ
ফারজানা লিখলোঃ
তুমি আমার বাবা-মা নও, আমার বন্ধু নও, তুমি আমার কাছে স্পেশাল কিছু যা আমি কোনদিনও ভুলবো না।
একটা কথা জানতে ইচ্ছা করছে। আমার নামটা কি তুমি অনেক উচ্চারণ করো?
মাসুদ লিখলোঃ
ফারজানা,
তোমার ই-মেইল পড়ে আমি খুব সুখী। তুমি খুব যোগ্য একজন মেয়ে। প্লিজ, আমাকে কখনো ত্যাগ করো না।
হ্যাঁ, আমি তোমার নাম অনেক উচ্চারণ করি। পুরো দিন-রাত তুমি আমার কল্পনায় উপস্থিত থাকো।
আমি তোমার সাথে অনেকবার কথা বলেছি। তুমি একজন লিটল গার্ল। আমি আশ্চর্য হয়েছি যে একজন ছোট্ট মেয়ে হয়ে অত উচ্চ পর্যায়ের কথা তুমি কিভাবে বলেছো!
রিয়েলী, তুমি একজন সুন্দর মনের মেয়ে। যদি তোমার মতো মেয়ে এই পৃথিবীতে অনেক অনেক থাকতো!
মাসুদ
ফারজানা লিখলোঃ
আমারও মনে হয় দিনে বহুবার আমার নাম মনে করো তুমি। আমি সুখী যে আমি তোমার কল্পনাতে থাকি। যে জগতে যাওয়া সবার ইচ্ছা থাকে, আমি খুব সাধারণ মানুষ হয়ে তা পেলাম। আমার ভাগ্য অনেকের চেয়ে ভালো।
এখন আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় জানতে চাচ্ছি। যদি বন্ধুত্ব অন্যদিকে মোড় নেয় তবে আমরা কি করবো --- ওহ, আমি তোমাকে কখনো ছাড়বো না ---- ওহ। সবসময় সুখে থাকো।
মাসুদ উত্তর দিলোঃ
ফারজানা,
প্রকৃতপক্ষে আমি খুব সিম্পল। কিন্তু তোমার মতো অসাধারণ মেয়ের সবচেয়ে সুখের মধ্য দিয়ে জীবনটা পার করা উচিৎ। সুতরাং তুমি যদি মনে করো যে তোমার সুখের জন্য আমার করণীয় আছে তাহলে আমি অবশ্যই তা করবো প্রিয় ফারজানা।
মাসুদ
ফারজানা লিখলোঃ
আমি তোমার খুব অভাব বোধ করছি, যদি এখন আল্লাহ্ আমাকে চড়ুই পাখি বানিয়ে দিতেন তবে উড়াল দিয়ে তোমার ডান হাতের কাছে গিয়ে বসতাম। কিন্তু আমরা তো মানুষ, আমরা অনেক কিছুই করতে পারি না যা আমরা চাই।
অবজেকশন, আমি লিটল গার্ল নই, আমি ১৮ প্লাস কুইন।
মাসুদ লিখলোঃ
হাই আঠারো,
তোমার কথা আমি মানতে পারলাম না। তুমি লিটল গার্ল না কিন্তু তুমি কুইনও না। তুমি কুইন এর ডটার হতে পারো।
আমার মনে হয়েছে যে তোমার অনেক জ্ঞান আছে যা বয়স্ক মানুষেরও থাকে না। এটা বোঝাতে গিয়ে আমি তোমাকে গার্ল বলেছি যে একজন ছোট্ট মেয়ে এত জানে কিভাবে?
মাসুদ
ফারজানা লিখলোঃ
হায় হায়, আমার বন্ধু তো একেবারে দিওয়ানা হয়ে গেছে! আমার মা আমাকে পরী বলে, তুমি বললে রানীকুমারী, কি মিষ্টি! আমি পৃথিবীর প্রথম রানীকুমারী। ইটস গ্রেট। ১৮ অথবা ১৮+ মহিলা জীবনের এক সুন্দর ধাপ। এই সময় প্রত্যেক চিন্তা এবং শব্দ খুব স্পেশাল, সুন্দর এবং রোমান্টিক। যে মহিলা এটাকে অনুধাবন ও উপভোগ করে তার বোধগুলো অন্যরকম হবে এবং ভাবগুলোও গভীর হবে। এখান থেকে আমার কথাগুলো আসে। আমি সব থেকে কম জ্ঞানের মানুষ।
বিশ্ব চড়াচড় লুপ্ত হয়ে যায়
একি ঘোরো প্রেম অন্ধ রাহু প্রায়।
প্রেম বয়স মানে না, দূরত্ব মানে না, প্রেম মুখশ্রী দেখে না, প্রেম মুখকে সুন্দর করে। আমাদের চোখ নিজের আলোতে দেখে না, দেখে বাইরের আলোতে, প্রেম বাইরের সেই আলো যে আলো কৃষ্ণের কালো রূপেও ভুবনের আলো খুঁজে পায়।
সখা ভালোবাসা কারে কয় সে যে কেবলই যাতনাময়!
মাসুদ লিখলোঃ
ফারজানা,
জীবন যৌবন গ্রাসে
তবে কেন তবে কেন মিছে এ কু আশা
ভালোবেসে যদি সুখও নাহি
তবে কেন তবে কেন মিছে ভালোবাসা।
মাসুদ
ফারজানা লিখলোঃ
সুহৃদ,
আমি তোমাকে খুব বেশী মিস করছি। আমার কেবল তোমার কাছে যেতে ইচ্ছা করে। ধুত্তোরি, কেন যে সাক্ষাৎ না করে ফ্লাই করলাম!
আমি তোমাকে কখনো সালাম দেই নাই, তাই না? একটা সালাম দিয়ে রাখি। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
সালাম পেয়ে মাসুদ ধাঁধাঁয় নিমজ্জিত হয়ে লিখলোঃ
ফারজানা,
ওয়া আলাইকুম আসসালাম। কিন্তু সালাম দেওয়ার কারণটা প্লিজ অবশ্যই জানাবে কিন্তু।
মাসুদ
ফারজানা লিখলোঃ
আমি তোমাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে এলে তুমি আসবে? কোন কারণে সালাম দেই নাই। জাস্ট জোক করেছি।
"ওয়ান (1), ফোর (4), থ্রী (3)"-এর অর্থটা বের করো।
মাসুদ লিখলোঃ
ফারজানা,
"ওয়ান, ফোর, থ্রী-এর অর্থ হলো আই লাভ ইউ
ওয়ান=আই
ফোর=লাভ
থ্রী=ইউ"
আমি কি কারেক্ট?
আজ তিনদিন হলো আমার জ্বর। মনে হচ্ছে, তুমি যদি পাশে থাকতে তবে আমার সব কষ্ট দূর হত।
মাসুদ
ফারজানা লিখলোঃ
জ্বর কিভাবে হলো? নিজের যত্ন নাও না? আমার ইচ্ছা করছে তোমার খুব কাছে চলে যাই, তোমার সব অসুস্থতা চুষে নেই, তোমার এক মুহূর্তের কষ্ট আমার ভালো লাগে না।
তুমি ১০০ গেইন করেছো। তোমার অনেক বুদ্ধি। তোমার জন্য দুটো লাইন মনে এসেছে-
দখিনা বাতাস এখন, ছুঁয়েছে যখন
কি দেব তোমায় বলো? কি আছে আমার তোমায় দেবার মতন!
দুইদিন পর মাসুদ লিখলোঃ
ফারজানা,
আজ জ্বর নাই। তোমার ইচ্ছা জেনে ভীষণ ভালো লাগলো। আমার কোন বুদ্ধি নাই। থাকলেও তা তোমারই কারণে।
কি দেবে আমায়? কি আছে দেবার মতন?
আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদটি চাই
কারণ সেটা আছে যে তোমারই কাছে!
মাসুদ
ফারজানা লিখলোঃ
কি সেই সম্পদ? আমাকে বলো, আমি তোমাকে দেব।
প্রতি মুহূর্তে তুমি থাকো আমার সকল চারিপাশে। আর কেউ নাই আমার জীবনে, কেবল তুমি। যখন ভাবি পাবো না তোমাকে তখন কেবল শূন্যতায় ভরে যায় মন, দুটি চোখ ভিজে যায় পানিতে। কেন তোমাকে ভালো লাগলো? কেন এত কষ্ট লাগে?
এরপর মাসুদ তার মোবাইলটা হারিয়ে ফেললো। পূর্বের নাম্বারের নতুন সীম কার্ড তুললো। ভাবলো যে দু/এক দিন পর মোবাইল কিনবে।
পরদিন ১১ই জুলাই সন্ধ্যায় ই-মেইল চেক দিয়েই চমকে উঠলো মাসুদ।
ফারজানা ১০ই জুলাই লিখেছেঃ
সারপ্রাইজ! আমি এখন বাংলাদেশে। কিন্ত তোমার ফোন সুইচ অফ। কিভাবে আমি তোমাকে কন্ট্যাক্ট করবো? প্লিজ এখনই আমাকে ফোন করো। ১২ই জুলাই ভোরেই আমি চলে যাবো।
আমি তোমাকে হারাতে পারবো না, আমার সহ্য হয় না তোমার বিরহ। খুব ইচ্ছা করে আমার মুখটা তোমার দু হাতের মাঝে ধরো, প্রিয়!
ফারজানা আবার লিখেছেঃ
সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্লিজ, এক মিনিট আমাকে ফোন করো। কোথায় তুমি? যাবার আগে একটু কথা বলবো, প্লিজ।
ফারজানা আবার লিখেছেঃ
আমার খুব কান্না পাচ্ছে। তোমার ফোন অফ কেন? তবে কি আমার ওয়ান সাইড লাভ। আমি কেবল তোমাকে অনুভব করি, তুমি করো না!
ফারজানা আবার লিখেছেঃ
আমি তোমার কাছে এলাম কিন্তু তুমি ফোন বন্ধ করে বসে আছো। আমার হয়তো কথা না বলেই চলে যেতে হবে। এত কেন লাগছে? তবে কি সত্য হিসাবে ধরে নেব প্রেম মানে কষ্ট, প্রেম মানে না বোঝা, প্রেম মানে অবহেলা?
মাসুদ উত্তর দিলঃ
ফারজানা,
তুমি আসবে তা আগে জানাওনি কেন? এত দ্রুত চলে যাবে কেন?
দশ মিনিট পর আমি তোমাকে ফোন করছি।
মাসুদ
দ্রুত মাসুদ রিক্সা নিয়ে এক বন্ধুর কাছে গেল।
বন্ধুর মোবাইলে সীম কার্ড লাগিয়ে ফোন করতেই ফারজানা বললো, তোমার মোবাইল বন্ধ ছিল কেন?
মাসুদ শুধুমাত্র মোবাইল হারানোর কথাটা জানালো।
ফারজানা বললো, মোবাইল হারানোর আর সময় পেলে না। আমার এক চাচা মারা যাওয়ায় দুইদিন আগে এসেছি। আব্বু একা আসতে চেয়েছিলেন। অনেক বলে কয়ে আব্বুর সাথে আসতে পেরেছি। তিনি অবাক হয়ে বলেছেন যে দেশে আসার জন্য আমি এত বেশি উতলা কেন? আজ কিন্তু সারারাত আমরা কথা বলবো।
ফারজানা আবার বললো, তোমাকে যদি যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যেতে চাই, যাবে?
মাসুদ বললো, তুমি না বলেছিলে যে তোমরা আবার চলে আসবে!
ফারজানা বললো, বাবা চান আমরা ওখানে থাকি। আমরা চাই এখানে থাকতে। এই নিয়েই তো এতদিন বিরোধ চলছিল। অবশেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে আমরা ওখানেই থাকবো।
মাসুদ হতাশ গলায় বললো, কিন্তু ওখানে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ফারজানা বললো, কেন?
মাসুদ বললো, পরে জানাবো। এখন রাখছি।
মাসুদ সীম খুলে মোবাইলটা বন্ধুকে ফেরত দিল।
ফারজানা সারারাত কথা বলতে চেয়েছে। মোবাইল বন্ধ পেয়ে সে কষ্ট পাবে।
কিন্তু আশি বছরের চেয়েও বেশি বয়স্ক বৃদ্ধ বাবার কথাও মাসুদের মনে পড়লো।
ওর বাবা ১৯৪৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন। ওর দাদা ছিলেন নিরক্ষর কৃষক। ছেলের কলেজে ভর্তি নিয়ে দুশ্চিন্তার মুহূর্তে ওদের গ্রামেরই বিত্তবান জামাল উদ্দিন যিনি ঐ সময়ই ঢাকায় ওষুধ কোম্পানীর মালিক ছিলেন, তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন মাসুদের দাদার কাছে নিজেকে ঋণী ভাবতেন বলে।
কারণ অনেকদিন পূর্বে একদিন মাসুদের দাদা মাঠে লাঙ্গল বাইছিলেন। এমন জায়গায় লাঙ্গল বাইছিলেন যে নিজেদের গ্রাম সেখান থেকে প্রায় মাইল খানেক উত্তরে এবং দক্ষিণেও প্রায় মাইল খানেক দূরে আরেকটি গ্রাম অবস্থিত।
মাসুদের দাদা হঠাৎ দেখেছিলেন, দক্ষিণের গ্রামটির দিক থেকে এক লোক দৌড়াতে দৌড়াতে আসছেন। কাছে আসার পর সমবয়সী জামাল উদ্দিনকে চিনতে পেরেছিলেন। জেনেছিলেন যে পরদিন তার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফরম পূরণের শেষ তারিখ। কিন্তু টাকার জোগাড় হয়নি। দক্ষিণের ঐ গ্রামের এক লোক টাকা দিতে চেয়েও দিলেন না।
তখন মাসুদের দাদা তাকে বাড়িতে নিয়ে এসে ন্যাকড়া দিয়ে বেঁধে রাখা টাকা একত্রিত করে তাকে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে তিনি ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন।
এই কারণেই তিনি মাসুদের দাদার জন্য কিছু করার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।
তিনি মাসুদের বাবাকে ঢাকা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন এবং নিজের বাড়িতে রেখেছিলেন। তখন ঢাকা কলেজের নাম ছিল ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। পুরনো ঢাকার বাড়িতে তিনি সবাইকে ডেকে বলেছিলেন যে ঐ বাড়ির প্রতিটি ইট বিক্রি করলেও তাদের ঋণ শোধ হবে না।
১৯৪৮ সালে মাসুদের বাবা ২৮তম স্থান দখল করে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছিলেন। তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন।
দুই বছর পরের পরীক্ষার সময় ফিজিওলজি বিভাগের ক্লাসে উপস্থিতির হার কম হয়েছিল। তখন জামাল উদ্দিনের এক ছেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ছাত্র অবস্থায়ও মাসুদের বাবার সাথে তিনি তার শ্যালিকার বিয়ে দিতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তার ক্ষোভ ছিল। তাই ফাইন দিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তিনি অনুমতি দিয়েছিলেন না।
ইতিমধ্যে মাসুদের দাদা এবং জামাল উদ্দিন মারা গিয়েছিলেন।
ঐ বাড়ি থেকেও তিনি বিতাড়িত হয়েছিলেন। পিতৃবিয়োগজনিত আর্থিক অনটনের কারণে এক বছর লস দিয়ে পড়াশোনা চালানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
তাই চাকরিতে জয়েন করেছিলেন। পড়াশোনার প্রতি প্রচন্ড ঝোঁক থাকায় পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। বি. এসসি. পাশ করে এ. জি. অফিসে চাকরি পেয়েছিলেন। কয়েক বছর পর প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। দুই বছর পর সুস্থ হলে বাড়ির লোকেরা তাকে আর ঢাকা যেতে না দিয়ে নিজেদের কাছেই রেখেছিলেন।
তারপর এলাকার হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।
মাসুদের বাবা কোন কারণে আবেগাপ্লূত হয়ে পড়লে এখনও কেঁদে ফেলেন আর ডাক্তার না হতে পারার জন্য আফসোস করেন। চোখের পানিতে তার সাদা দাঁড়ি ভিজে যায়।
ওরা অনেকগুলো ভাই-বোন। সামান্য একজন শিক্ষক হয়ে ওদেরকে মানুষ করার জন্যই তিনি সারাজীবন হিমশিম খেয়েছেন। তাই তিনি অনেক লিখলেও সেগুলো জনসমক্ষে আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন নি।
মাসুদ লেখাগুলো বই আকারে বের করাকে জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছে। তার বাবার মনের শুন্যতাই তাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে। ওর ধারণা, এই কাজ তার শুন্যতাকে কিঞ্চিৎ পরিমাণে হলেও দূর করতে পারবে। কারণ এখনই দেশের অনেক জায়গা থেকে তার বাবার কাছে বইয়ের প্রশংসাসুলভ ফোন আসে।
পরিবারের আর কারো এ কাজ করার মানসিকতা নেই। ফারজানার মত দুর্লভ মেয়ের টানে ওখানে গেলে এ কাজ বন্ধ হয়ে যাবে।
মাসুদ ভাবলো যে তার যুক্তরাষ্ট্রে না যেতে চাওয়ার কারণটা বুঝিয়ে বললে ফারজানাও হয়তো এ দেশে থাকতে চাইবে। তারপর তার বাবাকে বলবে। এতে তার বাবার রোষানলে পতিত হয়ে মাসুদ হয়তো মাটির সাথে মিশে যাবে। কাজেই তাকে পরে জানানোর কথা বললেও এখন আর বলা যাবে না।
মাসুদ কল্পনায় দেখলো, ফারজানার বাবা কষ্টাপ্লুত ফারজানাকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন এয়ারপোর্টের দিকে।
পরদিন ই-মেইল চেক দিয়ে মাসুদ দেখলো ফারজানা লিখেছেঃ
তোমার মোবাইল আবার বন্ধ! সবকিছু পরে জানাবো, পরে জানাবো, পরে জানাবো - আমি বিরক্ত।
আমি এত মাইল পার হয়ে তোমার সাথে কথা বলার জন্য ছুটে এলাম, আর তুমি এটা কি করলা! আমার জীবনটা কেমন নিরানন্দ হয়ে গেল।
মাসুদ ই-মেইলের উত্তর দিল না।
ফারজানার সাথে সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল? মাসুদ ভাবলো যে সম্পর্ক আরো দৃঢ় হলো। ফারজানাকে না পেলে অনেক কষ্ট পাবে সে। তাই মানসলোকে আজীবন সে থাকবে নিবিড়ভাবে উপস্থিত। তার সাথে রয়ে যাবে আত্মিক সম্পর্ক।
একটা গানের কলি মনে পড়লো মাসুদের ``বিরহে তোমারে পাই, হারাই মিলন ক্ষণে’’।
ওর বাবার বই তো ফারজানার কাছে খুব ভালো লেগেছিল। ফারজানার ভালো লাগার বিষয়ের মাঝেই তো সে থাকছে।